1. admin@newswatchbd.com : admin :
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৯:৩৩ অপরাহ্ন

মিল্টন এক আতঙ্কের নাম

বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশের সময় : শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪

 

# চাপা ক্ষোভ এলাকাবাসীর মনে
# মিল্টনের বিচার চান স্থানীয়রা
# আশ্রমের গেট বন্ধ, খুলছে না কর্মীরা

মিল্টন সমাদ্দার। তিনি ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান। সমাজে অনেকে তাকে মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে চিনলেও এর আড়ালে লুকিয়ে আছে তার ভয়ংকর রূপ। যা শুধু মিরপুরের পাইকপাড়াবাসী ও ভুক্তভোগীরাই দেখেছেন ও জেনেছেন।

তবে এতদিন তারা মুখ না খুললেও এখন কথা বলতে শুরু করেছেন। বিস্তর অভিযোগ আসতে শুরু করেছে তার বিরুদ্ধে। তার নাম শুনলেও অনেকে ভয় পেতেন। কারণ আশ্রমের পাশে চিৎকার ও ভেতরে প্রবেশ করার অপরাধে মারধরের শিকার হয়েছেন অন্তত ডজন খানেক ব্যক্তি। তাকে এ কাজে সহায়তার জন্য রয়েছে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী। যাদের কাজই হচ্ছে পান থেকে চুন খসলেই মারধর করা।

সেই সাথে মারধরের পর সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া। মারধরের শিকার ও মামলার ভয়ে এলাকার কেউ তার আস্তানায় ভয়ে যেতেন না। আর কেউ গেলে রক্ষা নেই। সব মিলে মিল্টন ছিলেন এলাকাবাসীর কাছে এক আতঙ্কের নাম।

বৃহস্পতিবার (০২ মে) সকাল থেকে বিকেল অবধি পাইকপাড়ায় অবস্থান করে এলাকাবাসী এবং ভুক্তভোগীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

মিল্টনের গ্রামের বাড়ি বরিশালে। সেখানে বাবাকে নির্যাতন করে মামলা খেয়ে চলে আসেন ঢাকায়। এরপর ভাড়া বাসায় থাকতে শুরু করে মিরপুরের পাইকপাড়া এলাকায়। খুলে বসেন মানবসেবার নাম দিয়ে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মাত্র একজন বৃদ্ধাকে দিয়ে শুরু করে এই বৃদ্ধ নিবাস।

২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করলেও এখন তার প্রতিষ্ঠানের ৩০ জনের মতো কর্মচারী, সাভারের বহুতল নিজস্ব ভবন, দুটি প্রাইভেটকার, থাকেন দামী ভাড়া বাসায়। শুধুমাত্র মানব সেবার নামে বৃদ্ধ নিবাস খুলেই মিল্টন এখন কোটিপতি।

এখন পর্যন্ত মিল্টনের নামে একটি মানবপাচার, মারধরের মাধ্যমে হত্যাচেষ্টা ও জাল মৃত্যুর সনদ তৈরির অভিযোগসহ তিনটি মামলা হয়েছে। একটি মামলা করেছেন পুলিশ বাদী হয়ে, বাকী দুটি মামলা করেছে দুই ভুক্তভোগী।

পাইকপাড়ার বাসিন্দা নাইমুল ইসলাম। মোহাম্মদপুর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন তিনি। গেল এপ্রিল মাসে তার এক বন্ধুর একটি কবুতর ওড়ে গিয়ে মিল্টনের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার ভবনে গিয়ে পড়ে। সেটি আনতে গিয়ে দুই বন্ধু মারধরে শিকার হন।

নাইমুল বলেন, হাকিম নামে এলাকার ছেলে, যে আশ্রমে কাজ করত। সে ফোন দিয়ে আমার বন্ধু সুজন মোল্লাকে বলছিল, তোর কবুতর আসছে। আইসা নিয়া যাইস। আমরা তার ফোন পেয়ে গেলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাকে যখন ডাকল সে বিষয়টি অস্বীকার করল। আমরা বুঝতে পারছিলাম ওরা ক্ষেপে যাচ্ছে। এরপর আমরা বের হয়ে আসতে চাইছিলাম।

তাছাড়া আমরা তো আগে থেকে জানি একটু কিছু হলেই তারা মারধর করে এবং চাঁদাবাজির মামলা দেয়। শুধু একটা নয় কয়েকটা কাহিনী আমরা জানি। আমরা হাবভাব দেখে বের হয়ে আসতেছিলাম। সুজনরে কইতেছিলাম চল। সে আমার পেছনে আর আমি তার সামনে। এ সময় তারা তাকে মারধর শুরু করে। আমি বাধা দিলে আমাকেও মারধর করা হয়। মুহূর্তে মিল্টনের লাঠিয়াল বাহিনীর ১০-১৫ জন ছুটে আসে এবং আমাদেরকে তারা মোটা মোটা লাঠি দিয়ে মারধর করে। রাহাত নামে একজন প্রথমে মারধর করে।

নাঈমুল ইসলাম ও সুজন মোল্লার সাথে গত ৪ এপ্রিল এমন ঘটনা ঘটে। নাঈমুল আরও বলেন, তাদের মারধরের বিষয়টি এক রিকশাচালক দেখে এলাকাবাসীকে খবর দিলে পরে লোকজন গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। পাশাপাশি এলাকাবাসীর সাথেও তার লোকেরা সংঘর্ষে জড়ায়। তারা এর প্রতিবাদও করেন।

এলাকাবাসী চান, মিল্টনের সকল অপরাধের শাস্তি হোক। মিল্টনের বাহিনীতে দেবাশিস, রাহাত, হাকিমসহ আরও ১৫ জনের মতো লোক রয়েছে। যাদের কাজই হচ্ছে কেউ সেখানে গেলে মারধর করা। বিষয়টি পুলিশও জানে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।

নাঈম বলেন, আমাদের এলাকায় একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে। এটা জেনে অনেকে দেখতে যায়। কিন্তু কেউ গেলে তাকে ধরে মারধর করে এবং চাঁদাবাজির মামলা দেওয়ার ফলে ভয়ে আতঙ্কে আর কেউ যায় না। আমরা তার অপকর্মের বিচার চাই। এমন একটা আতঙ্কবাদী লোকের হাত থেকে রক্ষা পেতে চাই।

মিল্টন মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা কয়জনের বিরুদ্ধে করেছে জানতে চাইলে নাঈম বলেন, আসলে বেশি তো মামলা করা লাগে না। উনি এরকম তিন চারটা মামলা করছে।

স্থানীয় এই যুবক আরও জানান, এক অন্ধ লোক ও আড়াই বছরের বাচ্চাকে সেখানে দিয়েছিল পরে সেই বাচ্চাকে এসে পাননি তিনি। এছাড়াও এক ব্যক্তি রাস্তা থেকে তুলে এনে এক অসুস্থ নারীকে তার বৃদ্ধাশ্রমে দিয়েছিলেন কিন্তু তাকে আর পরবর্তীতে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।

সম্প্রতি এক মাছ বিক্রেতাকেও মারধর করেছেন মিল্টন ও তার লোকজন। আর তা ছিল মাছের দাম দর নিয়ে তর্কের জের ধরে। এলাকাবাসী জানায়, সেই মাছওয়ালা মাছ নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু দামে বনিবনা না হওয়ায় তিনি চলে যাচ্ছিলেন। এ সময় কম দামে মাছ না দেওয়ায় তাকে মারধর করা হয়।

একজন মাছ বিক্রেতার সাথে দামে মেলেনি বলে কি তাকে ভেতরে নিয়ে মারধর করতে পারে- এমন প্রশ্ন রাখেন স্থানীয় এক বাসিন্দা।

এলাকাবাসীর মতে, মিল্টন ছিলেন এক আতঙ্কের নাম। তার নাম শুনলেও অনেকে ভয় পেতেন। তারা ভয়ে তার আস্তানায় যেতেন না। কেউ গেলে আর সুস্থ শরীরে ফিরে আসতে পারতেন না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার জন্য বুধবার ডিবি কার্যালয়ে অন্তত ছয় জন ব্যক্তি গিয়েছিলেন। যারা তার বিরুদ্ধে নানা বিষয়ে অভিযোগ দিয়েছেন। তার স্টাফরা সবসময় মারমুখী হয়ে থাকত। কেউ গেলেই তার সাথে খারাপ আচরণ করত তারা।

বছর খানেক আগে সমাজ সেবা অধিদফতরের নিরাপত্তা প্রহরী মন্টু নামের এক লোককেও মারধর করা হয়েছে। তিনি এলাকার নাইটগার্ড বলে পরিচিত। ছোটখাট একটি বিষয় নিয়ে মারধর করা হয় মন্টু নামের সেই বৃদ্ধকে।

এছাড়া বিপুল নামেও এক যুবক মিল্টনের আশ্রমের ওই ভবনে উঁকি মারার অপরাধে তাকে ভেতরে নিয়ে মারধর করা হয়। যেই উঁকি দেয় তার সাথে তর্ক লাগে। তখনই মারধর করা হয়। মূলত গত তিন চার বছর ধরে এলাকাবাসীর মাঝে এই আতঙ্ক চলছে।

এলাকার এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, মিল্টন তো এলাকার লোকদের পাত্তাই দিতেন না। তাদের সাথে মিশতেন না। তিনি মিশতেন বাইরের লোকদের। মনে করতেন তারাই তার শক্তি। কিন্তু কই সেইসব লোক! এলাকার লোক তার হাত থেকে মুক্তি চায়। তিনি বলেন, আমারা চাই এই প্রতারকের কঠিন শাস্তি হোক।

এসময় তার কথার সূত্র ধরে রুবেল নামে এক যুবক বলেন, মিল্টন তো মহা দাম্ভিক ছিলেন। তার কাছে যাওয়াই যেত না। আশ্রমে তিনি কি করেন, সেখানে কারা থাকেন তা কেউ জানতে গেলেই হয়রানি ও মারধর করতেন।

মিল্টনের বিরুদ্ধে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের শরীরের কিডনি বিক্রির যে অভিযোগ উঠেছে তা নিয়ে এলাকাবাসী জানিয়েছে, মূলত তিন বছর আগেও মিল্টন তার আশ্রমের লোকজন মারা গেলে পাশে থাকা এলাকার বাইতুস সালাম জামে মসজিদে লাশের গোসল করানো হতো। সেখানে নেওয়া লাশগুলোর শরীরের নিচে দিকে কোমরের ওপরে কাটা ছেঁড়ার দাগ দেখে তা তাকে জানালে এরপর থেকে তিনি লাশগুলো তার নিজ আশ্রমের ভেতরে গোসল করাতেন। এ নিয়ে প্রতিবেদনও হয়েছে পত্রিকায়।

তা নিয়ে এলাকাবাসীরা বলছেন, মিল্টন অভিযোগ বিভিন্ন মিডিয়ায় করেছেন এখানে লাশের গোসল করাতে নাকি টাকা লাগে! এটা মিথ্যা কথা। এখানে দাফনের কাপড় নাকি দেওয়া লাগে। যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তাদের কোনো টাকাই দেওয়া লাগে না। ওই কথাটা ওঠার পর থেকে মানুষের সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হয়ে গেছে। মূলত মসজিদের সামনের বাসার বাসিন্দা নাজিম নামে এক ব্যক্তি এই কাফনের কাপড় দেন বলে জানান তারা।

মনিরুজ্জামান নামে একজন বলেন, তার বাসায় কেউ প্রবেশ করলেই তিনি তাকে ধরে মারধরের পাশাপাশি চাঁদাবাজির মামলা দিতেন। আমরা চাই তার বিচার হোক। তার মতো যারা মানব সেবার নামে চাঁদাবাজি করতে আরও যারা ভিডিও বুস্ট করে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা যেন নেওয়া হয়।

বৃহস্পতিবার (২ মে) বিকেলে সরেজমিন মিরপুরের পাইকপাড়ার সেই বৃদ্ধ নিবাসে যাওয়া হলে গেট খোলেনি সেখানে কর্মরত নিরাপত্তা কর্মী মনির। তিনি জানান, ওপরের নির্দেশ খোলা যাবে না। এ বিষয়ে নাকি ডিবি তাদের বলেছে তারা যেন পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পযন্ত কাউকে প্রবেশ করতে না দেন। তবে এ বিষয়ে ডিবির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিষয়টি নিয়ে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের পুলিশের ডিসি জসিম উদ্দিন মোল্লা ঢাকা মেইলকে বলেন, আমরা এমন কোনো নির্দেশনা দেইনি। হয়তো অন্য কেউ দিয়ে থাকতে পারে। তবে তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে বলে জানি।

চাইল্ড এ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের ম্যানেজার আরাফাত হোসেন ঢাকা মেইলকে বলেন, সব কাজ আগের মতোই চলছে। কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না। তবে আমি মিরপুরে নেই। কোথায় আছেন জানতে চাইলে তা বলতে চাননি তিনি।

সর্বশেষ তথ্য হলো ভুয়া মৃত্যু সনদ প্রদানের অভিযোগে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় করা মামলায় মিল্টন সমাদ্দারের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার (২ মে) ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালত শুনানি শেষে এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ

আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
© স্বত্ব সংরক্ষিত © ২০২৩ নিউজ ওয়াচ বিডি
প্রযুক্তি সহায়তায় Shakil IT Park